তৎকালীন আরবের অবস্থা

wpid-img_20150513_105827.jpgআরবের মরুদুলাল শেষনবী মুহাম্মদ (ছাঃ) মক্কায় জন্মগ্রহন করেন। তাই আমরা প্রথমে আরবদেশ সম্পর্কে আলোকপাত করব। তাই আমরা প্রথমে আরবদেশ সম্পর্কে আলোকপাত করব।
আরবের অবস্থান স্থল:
মক্কাকে পৃথিবীর নাভীস্থল বলা হয়। কুরআনে একে “উম্মুল ক্বোরা” বা “আদি জনপদ” বলা হয়েছে (আনআম ৬/৯২; শূরা ৪২/৭)। তিনদিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যপী আরব উপদ্বীপ কেবল পুথিবীর মধ্যস্থলেই অবস্থিত নয়, বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহজ যোগাযোগস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। বর্তমানে ফ্রান্সের প্রায় দ্বীগুণ এই বিশাল ভূখণ্ডটির অধিকাংশ এলাকা মরুময়। অথচ এই ধূসর মরুর নীচে রয়েছে আল্লাহর রহমতের ফাল্গুধারা, বিশ্বের মূল্যবান তরল সোনার সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্বে আরব সাগর এবং উত্তরে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখণ্ড। পানিপথ ও জলপথে আরব উপদ্বীপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশের সাথে যুক্ত। আদি পিতা আদম, নূহ, ইদ্রিস, ছালেহ, ইব্রাহীম, লূত, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকুব. শুয়ায়েব, মূসা, দাউদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আঃ) এবং আমাদের সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (ছাঃ) সহ সকল নবী ও রাসূলের আবির্ভাব ও কর্মস্থল ছিল এই পবিত্র ভূখণ্ড।
এর প্রথম কারণ ছিল অনুর্বর এলাকা হওয়ার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরবদের নিয়মিত বাণিঝ্যিক যোগাযোগ থাকায় এখানে নবুঅতের দাওয়াত দিলে তা সাথে সাথে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত।
দ্বিতীয় কারণ: এই ভূখণ্ডে ছিল দুটি পবিত্র স্থানের অবস্থিতি। প্রথমটি এবং সর্বশ্রেষ্ঠটি ছিল মক্কার বায়তুল্লাহ বা কা’বা শরীফ। যা হযরত আদম (আঃ) কতৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনঃনির্মিত হয়। দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস, যা কা’বা গৃহের চল্লিশ বছর পর আদম পুত্রের কারো হাতে নির্মিত হয়। অতঃপর ইব্রাহীমের পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কতৃক নির্মিত হয়। অতঃপর দাউদ ও সুলাইমান (আঃ) কতৃক পুন:নির্মিত হয়। ইব্রিাহীম পুত্র ইসমাঈল -এর বংশধরগণ মক্কা এলাকা আবাদ করেন এবং বংশ পরম্পরায় তাঁরাই বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, হাজী ছাহেবদের জানমালের হেফাযত, তাদের পানি সরবরাহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ইবরাহীমের কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ) -এর বংশধরগণ বায়তুল মুকাদ্দাস তথা আজকের ফিলিস্তীন এলাকায় বসবাস করেন। ইসহাকপুত্র ইয়াকুব (আঃ) -এর অপর নাম ছিল ইসরাঈল। সেকারণে তাঁর বংশধর বনু ইসরাঈল নামে খ্যাত। এভাবে আরব উপদ্বীপের দুই প্রধান এলাকা সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইবরাহীমের বংশধর বনু ইসমাঈল ও বনু ইসরাঈল কর্তৃক তাওহীদের দাওয়াত প্রসার লাভ করে। সাথে সাথে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্বাচন করেছেন আদম ও নূহকে এবং ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে জগত বাসীর মধ্য হতে। তাঁরা একে অপরের সন্তান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ” (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪)।
রাজনৈতিক অবস্থা:
এই সময়ে আরবের দক্ষিণাংশে ছিল হাবশার সম্রাজ্য, পূর্বাংশে ছিল পারসিক সম্রাজ্য এবং উত্তরাংশের ভূখণ্ড সমূহ ছিল রোমক সম্রাজ্যের করতলগত। সম্রাট শাসিত এইসব অধিবাসীগণ সবাই ছিল ধর্মের দিক দিয়ে খৃষ্টান। যদিও প্রকৃত ধর্ম বলে সেখানে কিছুই ছিল না। মক্কা ও ইয়াছবির (মদিনা) সহ আরবের বাকি ভূখণ্ডেল লোকেরা স্বাধীন ছিল। তাদের কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। তবে তারা গোত্রপতি শাসিত ছিল। তাদের মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও বেপরোয়া ভাবটা ছিল বেশী। তাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য দোষ-ত্রুটি ছিল, তেমনি ছিল অনন্য সাধারণ গুণাবলী, যা অন্যত্র কদাচিত পাওয়া যেত। তাদের সৎসাহস, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অতিথিপরায়ণতা ছিল কংবদন্তিতুল্য। বছরে চার মাস তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। মক্কার লোকেরা ইহুদি বা খৃষ্টান ছিল না। তারা নিজেদেরকে ইবরাহীম (আঃ) এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (একনিষ্ঠ একত্ববাদী) বলত। মক্কা ছিল সমগ্র আরব ভূখণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সেকারণে খৃষ্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। এক সময় ইয়েমেনের নরপতি আবরাহা নিজ রাজধানীতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কাবা গৃহের আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ্জ করার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু জনগণ তাতে সাড়া দেয় নি। বরং কে একজন গিয়ে ঐ নকল কাবা গৃহে (?) পায়খানা করে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে প্রায় ৬০,০০০ সৈন্য ও হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করে কাবা গৃহকে ধংস করার জন্য। অবশেষে আল্লাহর গযবে তিনি নিজে তার সৈন্যসামন্ত সহ ধংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায় এবং এ ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। শেষনবী মুহাম্মদ (ছাঃ) এর ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। বস্তুতঃ এটা ছিল শেষ নবীর আগমনের আগাম শুভ সংকেত।
সমস্ত আরব ভূখণ্ডে মক্কার ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা শীতকালে ইয়েমেনে ও গ্রষ্মকালে শাম বা সিরিয়ায় ব্যবসার জন্য যাতায়াত করত। কিন্তু এই দীর্ঘ সফরে কখনো তাদের কাফেলা লুট হতো না। হারাম শরীফের মর্যাদার কারণে আপামর জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা এমন ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাদের সমীহ করত। এটাই যেখানে বাস্তবতা সেখানে তাদেরকে ‘জাহেলী আরব’ কেনো বলা হয়? এর কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ) -এর অনুসারী হবার দাবীদার হওয়া সত্বেও আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তি পূজা শুরু করেছিল। তারা শেষ নবীকে চিনতে পেরেও তাঁকে অস্বীকার করেছিল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল সবচেয়ে বড় জাহেলিয়াত ও সবচেয়ে বড় মূর্খতা। আর একারণেই তো “জ্ঞানের পিতা” আবুল হেকাম -কে “মূর্খতার পিতা” আবু জাহলকে দেওয়া হল।
এক্ষনে আমরা মক্কার শিরক প্রসারের ইতিবৃত্য সংক্ষেপে বর্ণনা করব :-
মক্কার ধর্মীয় অবস্থা (শিরকের প্রচলন):
মক্কার লোকেরা মূলতঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ) -এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কাবা গৃহকে যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে তাওয়াফ, সাই ও হজ্জ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজ নেতা ও ধনিক শ্রেনীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের মাধ্যমেই মূর্তি পূজার শিরকের সূচনা হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নুহ (আঃ) -এর সমাজে হয়েছিল।োর-ডাকাতেরাও তাদের সমীহ করত। এটাই যেখানে বাস্তবতা সেখানে তাদেরকে ‘জাহেলী আরব’ কেনো বলা হয়? এর কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ) -এর অনুসারী হবার দাবীদার হওয়া সত্বেও আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তি পূজা শুরু করেছিল।
(১) কুরায়েশ বংশের বনু খোযা’আহ গত্রের সর্দার আমর বিন লুহাই অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল এবং দরবেশ স্বভাবের লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং অন্ধভক্তি পোষন করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হত। অতএব শয়্তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামে গিয়ে দেখলেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের সাথে “হোবল” নামক মূর্তির পূজা করে। এর অসীলায় তারা বৃষ্টি প্রার্থনা করে। আমর ভাবল অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্ম ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন এই হোবল মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব। ফলে বহু মুল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরিদ করে নিয়ে গেল এবং মক্কার নেতাদের রাজি করিয়ে কা’বাগৃহে স্থাপন করল। কথিত আছে যে, একটা জীন আমরের অনুগত ছিল। (২) আর সেই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আঃ) -এর সময়কার অদ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াউক্ব, নাসর (নূহ ৭১/২৩) প্রতিমাগুলো জেদ্দার অমুক স্থানে মাটিতে গ্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিলো। অতঃপর হজ্জ এর মৌসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সোপর্দ করে দিলো। এসব মূর্তি ছাড়াও আরবের প্রাচিনতম মূর্তি ছিল লোহিত সাগরের নিকটবর্তী মুসাল্লাল নামক স্থানের “মানাত”, ত্বায়েফের “লাত” এবং নাখলা উপত্যকার ” ওয্যা” সবচাইতে প্রসিদ্ধ।
এভাবে আস্তে আস্তে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তির প্রচলন ঘটে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা’বা গৃহে ৩৬০টি মূর্তি দেখতে পান এবং সবগুলো বের করে এনে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেন ও কা’বাগৃহ পানি দিয়ে ধুয়ে সাফ করে ফেলেন।
বিদআতের প্রচলন:
মূর্তিপূজা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীমের উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম আছে। কেননা আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিল যে, এগুলি ইবরাহীমী দ্বীনের বিকৃতি নয়, বরং ‘বিদআতে হাসানাহ’। অর্থাৎ ভালো কিছুর সংযোজন মাত্র। এজন্য সে বেশ কিছু ধর্মীয় রীতি-পদ্ধতি আবিস্কার ও চালু করেছিল। যেমন-
(১) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয় বিনয় করে প্রার্থণা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদের আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩৯/৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশ করবে (ইউনুস ১০/১৮)।
(২) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, তাওয়াফ করত, তার সামনে প্রণত হত ও সিজদা করত।
(৩) তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত। সেখানে মূর্তির নামে কুরবানী করত (মায়েদাহ ৫/৬)।
(৪) তারা মূর্তিকে খুশি করার জন্য গবাদি পশু ও তাদের জন্য চরণক্ষেত্র মানত করত। যাদের কেউ ব্যবহার করতে পারত না (আনআম ৬/১৩৮-১৪০)।
(৫) তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভালো-মন্দ ফলাফল ও ভাগ্য নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকার তীর ব্যবহার করত। যাতে হ্যা, না, ভালো, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে অতঃপর তাতে ঝাকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুরিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত।
(৬) এতদ্ব্যতীত তারা জোতিষীদের কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গল-অমঙ্গলের কারণ মনে করত।
(৭) তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত।
দ্বীনে ইবরাহীমে উক্ত শিরক ও বিদআতসমূহ চালু করার পরেও তাদের অহংকার ছিল এই যে, (১) আমরা ইবরাহীম (আঃ) -এর দ্বীনে হানীফের খাটি অনুসারী। তারা কা’বা গৃহের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। অতএব তাদের সমকক্ষ আরব ভুখণ্ডে কেউ নেই। তাদের এই বড়ত্ব ও আভিজাত্যের অহংকার এতদূর পৌছে গিয়েছিল যে, তারা যেহেতু “হুমস” অর্থাৎ “সবচাইতে বড় বীর ও বড় ধার্মিক” অতএব তাদের পক্ষে “হারাম” -এর সীমানার বাইরে কোন হালাল এলাকায় যাওয়াটা মর্যাদাকর নয়। তারা যেহেতু “ক্বাতীন” বা ” আহলুল্লাহ” অর্থাৎ ” আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা” সেকারণে হজ্জের মৌসুমে “মুযদালিফায়” অবস্থান করত, যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে। হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ “তাওয়াফে আফাযাহ” করত না। যা ছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় রুকন। তারা মুযদালিফায় অবস্থান করত এবং সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসত। সেজন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন, ” অতঃপর তোমরা ঐ স্থান থেকে ফিরে এসো তাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে (অর্থাৎ আরাফাত থেকে)। (বাক্বারাহ ২/১৯৯)
(২) এতদ্ব্যতীত তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম তাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় কাপড় পরিধান করবে। সম্ভবতঃ এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থদুষ্ট বিদআত ছিল। যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তবে পুরুষরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পরে তাওয়াফ করবে। এতে তাদের দেহ এক প্রকার নগ্নই থাকত। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন, “হে বনু আদম! প্রতিবার মসজিদে উপস্থিত হবার সময় তোমাদের পোষাক পরিধান কর” (আরাফ ৭/৩১)। তাদের কাছ থেকে “হুমস” কাপড় কিনতে বাধ্য করার জন্য তারা এ বিধানও করেছিল যে, যদি বহিরাগত কেউ উত্তম পোষাকে এসে ত্বাওয়াফ করে, তাহলে ত্বাওয়াফ শেষে তাদের ঐ পোষাক খুলে রেখে যেতে হবে। যার দ্বারা কেউ উপকৃত হত না। (৩) তাদের বানানো আরেকটা বিদআতী রীতি ছিল এই যে, তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ীর সম্মুখ দিক দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু বাকী আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ির পিছন দিকের সরু পথ দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। সম্মুখ দরজা দিয়ে নয়। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে বৈষম্যগত শ্রেষ্ঠত্যের গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
” আর পিছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। বরং মঙ্গল রয়েছে আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। তোমরা ঘরে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে” (বাক্বারা ২/১৮৯)।
উপরোক্ত আলোচনায় তৎকালীন আরবের ও বিশেষ করে মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত শিরক ও বিদআতসমূহের একটা চিত্র পাওয়া গেল। যা তারা ইবরাহীম (আঃ) -এর একত্ববাদী দ্বীনে হানীফের মধ্যে ধর্মের নামে চালু করেছিল।
ইয়াছরিবের ইহুদী-নাছারাদের অবস্থা:
অপর পক্ষে যারা ইহুদী-নাছারা ছিল, যারা প্রধানতঃ ইয়াছরিবে (মদীনায়) বসবাস করত, যারা অত্যাচারী রাজা বখত নছর কতৃক কেনআন (ফিলিস্তিন) থেকে উৎখাত হওয়ার পর ইয়াছরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস হারিয়েছে, অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পথেয় হাছিল করবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তার আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তার দ্বীন কবুল করবে এবং তার নেতৃত্বে আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারণা ছিল আখেরী নবী অবশ্যই তাদের বংশ থেকে হবেন। কিন্তু তা না হওয়াতেই হল যত বিপত্তি। তাদের মধ্যে তাওরাত-ইঞ্জিলের কোন শিক্ষা অবশিষ্ট ছিল না। তাদের ধর্ম ও সমাজ নেতারা ভক্তদের কাছে “রব” এর আসন দখল করেছিল। ইহুদীরা ওযায়েরকে আল্লাহর বেটা বানিয়েছিল এবং নাছারারা মসীহ ঈসাকে একইভাবে দাবী করেছিল (তওবাহ ৯/৩০-৩১)। বরং তারা মারিয়াম, ঈসা ও আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তাদের পীর-দরবেশরা বাতিল পন্থায় ধর্মের নামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লুট করত এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতো (তওবাহ ৯/৩৪)। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম করত না (তওবাহ ৯/২৯)। এক কথায় তাওরাত-ইঞ্জিলের বাহক হবার দাবীদার হলেও তারা ছিল পূরা সেচ্ছারী দুনিয়াদার।
আরবের সামাজিক অবস্থা:
(ক) নারীদের অবস্থা: তৎকালীন আরবে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন বাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণির লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল। পুরুষ প্রধাণ সমাজ ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের ছিল মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও নায় ভিত্তিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। বহু ব্যপারে মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়া হত। তাদের যুক্তিসঙ্গত কথাবার্তার যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষন ও তাদের মান সম্মান অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত। তাদের মর্যাদা হানিকর কোন অবস্থার উদ্ভব ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তরবারি কোষমুক্ত হয়ে যেত। মহিলাদের মর্যাদা এতই উচুতে ছিল যে, বিবদমান গোত্রগুলিকে একত্রিত করে সন্ধিচুক্তি মম্পাদনেও তারা সক্ষম হত। পক্ষান্তরে তাদের উত্তেজিত বক্তব্যে ও কাব্য গাথায় যেকোন সময় দুই গোত্রে যুদ্ধ বেধে যেতে পারত। ওহুদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার সাথী মহিলাদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে এই কাজটিঈ করেছিল। তাদের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উচু মানের। উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতি ও কনের স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে নির্ধারিত মোহরানা দিয়ে বিয়ে করতে পারত। বিয়েতে ও সন্তানের আক্বীকাতে সমাজ নেতাদের দাওয়াত করে ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠান করা তাদের সামাজিক রেওয়াজ ছিল।
অপরপক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণির আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল। এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেণীর মত পারস্পরিক সম্মতি ও মোহরানা বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্তু বাকী তিনটাকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা উচিত। যা ভারতীয় হিন্দু সমাজে রাক্ষস বিবাহ, গান্ধর্ব্য বিবাহ ইত্যাদি নামে আধুনিক যুগেও চালু আছে বলে জানা যায়। আরবীয় সমাজে স্বাধীনা ও দাসী দুই ধরনের নারীদের অস্তিত্ব ছিল। দাসীদের অবস্থা ছিল মানবেতর। তারা বাজার-ঘাটে বিক্রয় হত। মনিবের মনোরঞ্জনই ছিল তাদের প্রধান কাজ। স্বাধীনাগণ সমাজে সম্মানিতা হিসাবে গণ্য হতেন।
(খ) গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা: আরবদের সমাজ ব্যবস্থা গোত্র প্রধান হওয়ার কারনে বংশীয় ও আত্বীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত। মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপর নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হত। নায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণিত হত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। আজকালকের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলী আরবের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়। বরং তাদের চাইতে নিম্নতর স্তরের দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। কেননা তখনকার যুগের ক্ষয়-ক্ষতির চাইতে আজকের যান্ত্রিক যুগের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়ভাবে বেশী। গোত্রসমূহের মধ্যে প্রায়ই যুধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারণে তারা অধিক সংখায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককেই সবাই সমীয় করত। যুদ্ধে পরাজিত হলে নারীদের বেইযযতি ও তাদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দারিদ্রতার কারণে অনেকে কন্যা সন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত। তাদের কোন গোত্রীয় আর্থিক রিজার্ভ ছিল না। যুদ্ধ শুরু হলে সবাই প্রয়োজনীয় ফান্ড গোত্র নেতার কাছে জমা করত ও তা দিয়ে যুদ্ধের খরচ মেটাত। তবে পূর্ব থেকেই ধর্মীয় রীতি চলে আসার কারণে তারা বছরে চারটি সম্মানিত মাসে (যুল-ক্বাদাহ, যুলহিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব) যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ রাখতো। এটা ছিল তাদের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রক্ষাকবচ। গোত্র নেতারা একত্রে বসে সামাজিক শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা, কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধ শুরু বা শেষ করা কিংবা সন্ধিচুক্তি করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করত। মক্কার “দারুন নাদওয়া” ছিল এজনয় বিখ্যাত [#১]। তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশীশক্তি-ই জয় লাভের মানদন্ড ছিল। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে “জোর যার মুল্লুক তার” নীতিতে পরিচালিত হত। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেই উন্নত নয়।
[ #১ “দারুন নাদওয়া” ছিল মসজিদে হারাম সংলগ্ন কুছাই বিন কেলাবের বাড়ী। ইসলামী যুগে এটি মসজিদুল হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ]
অর্থনৈতিক অবস্থা: ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। ত্বায়েফ, সিরিয়া, ইয়ামন প্রভৃতি উর্বর এলাকা ছাড়াও অন্যত্র পশু-পালন জনগণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। উট ছিল বিশেষ করে দুরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। গাধা ও খচ্চর মূলতঃ স্থানীয় পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হত। মক্কার ব্যবসায়ীগণ শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দুরপাল্লার ব্যবসায়ীক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সূদের প্রচলন ছিল। তারা চক্রবৃদ্ধি হারে পরস্পরকে সূদভিত্তিক ঋণ দিত। রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই ব্যবসায়িক কাফেলা লুট হত। সেজন্য সশস্ত্র যোদ্ধাদল নিয়ে ব্যবসায়ী কাফেলা রওয়ানা হত। তবে কাবা গৃহের খাদেম হওয়ার সুবাদে মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা বিশেষভাবে মর্যাদামন্ডিত ছিল এবং সর্বত্র নিরাপদ থাকত। বছরের আট মাসে লুটতরাজের ভয় থাকলেও বাকী চার মাস তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করত। এই সময় ওকাযের মেলা ছাড়াও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে আরো অনেকগুলি বড় বড় মেলা বসত। এইসব বানিজ্য মেলায় বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হত। তাদের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম ও ধাতব শিল্পের প্রচলন ছিল। ইয়ামন, হীরা ও সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল এইসব শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। তবে গৃহের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলাকে নিয়োজিত দেখা যেত। কোন কোন এলাকায় কৃষি কাজ হত। ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙ্গুরের চাষ হত। মক্কা-মদীনায় গমের আবাদ ছিল না। আমীর মুআবিয়ার খেলাফতকালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদীনায় গম রফতানী করা হয়। খেজুর বাগান ব্যপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।
তাদের কোন গোত্রীয় অর্থনৈতিক ফান্ড ছিল না। সেকারণে সমাজের লোকদের দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি দুরিকরণে ও স্বাস্থসেবার কোন সমন্বিত কর্মসূচি ও কর্মপরিকল্পনা ছিল না। পারস্পরিক দান ও বদান্যতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হত। নিখাদ পূজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে এক দল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক বিত্তহীন ও মানবেতর জীবন যাপন করত। সাধারন অবস্থা ছিল এই যে, আরবদের সহায়-সম্পদ তাদের জীবন্মান উন্নয়নে ব্যয়িত না হয়ে সিংহভাগই ব্যয়িত হত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে। ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র‍্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। আজকের বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর চেয়ে মোটেই উন্নত নয়। আরবীয় সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ, জুয়া ইত্যাদির ব্যপক প্রচলন ছিল। সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরুপে বিক্রয় হত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হত।
নৈতিক অবস্থা: উদার মরুচারী আরবদের মধ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ধারা পরিলক্ষিত হত। একদিকে যেমন তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি-হানাহানি লেগে থাকত। অন্যদিকে তেমনি দয়া, উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা ও অনাড়ম্বতা, দানশীলতা, আমানতদারী, মেহমানদারী, প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা ইত্যাদি সৎ গুণাবলীর সমাবেশ দেখা যেত। তাদের কাব্য প্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের কাছে আধুনিক যুগের আরবি কবি-সাহিত্যিকরা কিছুই নয়। তাদের স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই হুবহু মুখস্ত বলে দিত। বড় বড় ক্বাদীছা ও দীর্ঘ কবিতাগুলি তাদের মুখে মুখেই চালু ছিল। লেখাকে এজন্য তারা নিজেদের জন্য হীনকর মনে করত। দুর্বল স্মৃতির কারণে আজকের বিশ্ব লেখাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ লেখায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল কদাচিৎ হত। সম্ভবতঃ এইসব সদ গুণাবলীর কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতেই প্রেরণ করেন। যাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদীছ অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীতে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কুরআন ও হাদীছ লিখিত ভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল।
উপসংহার:
উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভুখন্ডের মরুচারী মানুষেরা বিভিন্ন মানবিক দুর্বলতার অধিকারী হলেও তাদের মধ্যে উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঈর্ষণীয়ভাবে পরিদৃষ্ট হত। আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার অবতরনস্থল হওয়ার কারণে এই ভুখণ্ড থেকেই মানব সভ্যতা ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য ভুখণ্ডে বিস্তার লাভ করেছে… এই ভুখণ্ডে আরাফাত -এর না’মান উপত্যকায় সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহ পাক সমস্ত মানবকূলের নিকট হতে তাঁর প্রভুত্বের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন (আরাফ ৭/১৭২-১৭৩)। একই সাথে তিনি সকল নবীর কাছ থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর উপরে ঈমান আনা ও ত্ঁাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতার অঙ্গীকার নেন (আলে ইমরান ৩/৮১)।
এই ভুখণ্ডে হাযার হাযার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। এই ভুখণ্ডেই আল্লাহর ঘর কা’বাগৃহ অবস্থিত। এই ভুখণ্ড বানিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জান্নাতের ভাষা আরবী এই ভুখণ্ডের কথিত ও প্রচলিত ভাষা ছিল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, প্রখর সৃতিশক্তি এবং সততা ও আমানতদারীর অনুপম গুণাবলীর প্রেক্ষাপটে আরব ভূমির কেন্দ্রবিন্দু মক্কাভূমির অভিজাত বংশ কা’বা গৃহের তত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাঃ) -এর নিকটেই আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত শ্রেষ্টতম নে’মত কুরআন ও সুন্নাহর আমানত সমর্পণ করেন। ফালিল্লা-হিল হামদ। এক্ষণে আমরা নবীজীবনের মূল আলোচনায় অগ্রসর হব।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ -১:
(১) বিশ্বনবী ও শেষনবী হবার কারণেই বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতে মুহাম্মাদ (ছাঃ) -কে প্রেরণ করা হয়।
(২) সারা বিশ্বে তাওহীদের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন বিশ্বের সেরা বাণিজ্য কেন্দ্র ও যোগাযোগ কেন্দ্র আরব ভূখণ্ডে শেষনবী প্রেরিত হন।
(৩) তাওরাত-ইঞ্জিল হিব্রু ভাষায় নাযিল হয়। কিন্তু কুরআন নাযিল হয়েছে জান্নাতী ভাষা আরবীতে। তাই আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক শুদ্ধভাষী আরব তথা কুরায়েশ বংশে শেষনবীর আগমন ঘটে।
(৪) আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র সে যুগে ছিল না। তাই প্রখর স্মৃতিধর আরবদের নিকটেই কুরআন ও সুন্নাহর অমূল্য নে’মত সংরক্ষণের আমানত সমর্পণ করা হয়।
(৫) আরবরা ছিল আজন্ম স্বাধীন ও বীরের জাতি। তাই তৎকালীন রোমক ও পারসিক পরাশক্তির মুকাবিলায় ইসলামী খেলাফতের বাস্তবায়নের জন্য শেষনবীর আগমনস্থল ও কর্মস্থল হিসাবে আরব ভূখণ্ডকে নির্বাচন করা হয়।

Leave a comment