মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবন কাহিনী

মুহাম্মাদ (সা:) এর জীবন কাহিনী

wpid-img_20150513_105827.jpg

1. তৎকালীন আরবের অবস্থা

আরবের মরুদুলাল শেষনবী মুহাম্মদ (ছাঃ) মক্কায় জন্মগ্রহন করেন। তাই আমরা প্রথমে আরবদেশ সম্পর্কে আলোকপাত করব। তাই আমরা প্রথমে আরবদেশ সম্পর্কে আলোকপাত করব।

আরবের অবস্থান স্থল:

মক্কাকে পৃথিবীর নাভীস্থল বলা হয়। কুরআনে একে “উম্মুল ক্বোরা” বা “আদি জনপদ” বলা হয়েছে (আনআম ৬/৯২; শূরা ৪২/৭)। তিনদিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যপী আরব উপদ্বীপ কেবল পুথিবীর মধ্যস্থলেই অবস্থিত নয়, বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহজ যোগাযোগস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। বর্তমানে ফ্রান্সের প্রায় দ্বীগুণ এই বিশাল ভূখণ্ডটির অধিকাংশ এলাকা মরুময়। অথচ এই ধূসর মরুর নীচে রয়েছে আল্লাহর রহমতের ফাল্গুধারা, বিশ্বের মূল্যবান তরল সোনার সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্বে আরব সাগর এবং উত্তরে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখণ্ড। পানিপথ ও জলপথে আরব উপদ্বীপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশের সাথে যুক্ত। আদি পিতা আদম, নূহ, ইদ্রিস, ছালেহ, ইব্রাহীম, লূত, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকুব. শুয়ায়েব, মূসা, দাউদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আঃ) এবং আমাদের সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (ছাঃ) সহ সকল নবী ও রাসূলের আবির্ভাব ও কর্মস্থল ছিল এই পবিত্র ভূখণ্ড।

এর প্রথম কারণ ছিল অনুর্বর এলাকা হওয়ার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরবদের নিয়মিত বাণিঝ্যিক যোগাযোগ থাকায় এখানে নবুঅতের দাওয়াত দিলে তা সাথে সাথে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত।

দ্বিতীয় কারণ: এই ভূখণ্ডে ছিল দুটি পবিত্র স্থানের অবস্থিতি। প্রথমটি এবং সর্বশ্রেষ্ঠটি ছিল মক্কার বায়তুল্লাহ বা কা’বা শরীফ। যা হযরত আদম (আঃ) কতৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনঃনির্মিত হয়। দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস, যা কা’বা গৃহের চল্লিশ বছর পর আদম পুত্রের কারো হাতে নির্মিত হয়। অতঃপর ইব্রাহীমের পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কতৃক নির্মিত হয়। অতঃপর দাউদ ও সুলাইমান (আঃ) কতৃক পুন:নির্মিত হয়। ইব্রিাহীম পুত্র ইসমাঈল -এর বংশধরগণ মক্কা এলাকা আবাদ করেন এবং বংশ পরম্পরায় তাঁরাই বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, হাজী ছাহেবদের জানমালের হেফাযত, তাদের পানি সরবরাহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ইবরাহীমের কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ) -এর বংশধরগণ বায়তুল মুকাদ্দাস তথা আজকের ফিলিস্তীন এলাকায় বসবাস করেন। ইসহাকপুত্র ইয়াকুব (আঃ) -এর অপর নাম ছিল ইসরাঈল। সেকারণে তাঁর বংশধর বনু ইসরাঈল নামে খ্যাত। এভাবে আরব উপদ্বীপের দুই প্রধান এলাকা সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইবরাহীমের বংশধর বনু ইসমাঈল ও বনু ইসরাঈল কর্তৃক তাওহীদের দাওয়াত প্রসার লাভ করে। সাথে সাথে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্বাচন করেছেন আদম ও নূহকে এবং ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে জগত বাসীর মধ্য হতে। তাঁরা একে অপরের সন্তান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ” (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪)।

রাজনৈতিক অবস্থা:

এই সময়ে আরবের দক্ষিণাংশে ছিল হাবশার সম্রাজ্য, পূর্বাংশে ছিল পারসিক সম্রাজ্য এবং উত্তরাংশের ভূখণ্ড সমূহ ছিল রোমক সম্রাজ্যের করতলগত। সম্রাট শাসিত এইসব অধিবাসীগণ সবাই ছিল ধর্মের দিক দিয়ে খৃষ্টান। যদিও প্রকৃত ধর্ম বলে সেখানে কিছুই ছিল না। মক্কা ও ইয়াছবির (মদিনা) সহ আরবের বাকি ভূখণ্ডেল লোকেরা স্বাধীন ছিল। তাদের কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। তবে তারা গোত্রপতি শাসিত ছিল। তাদের মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও বেপরোয়া ভাবটা ছিল বেশী। তাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য দোষ-ত্রুটি ছিল, তেমনি ছিল অনন্য সাধারণ গুণাবলী, যা অন্যত্র কদাচিত পাওয়া যেত। তাদের সৎসাহস, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অতিথিপরায়ণতা ছিল কংবদন্তিতুল্য। বছরে চার মাস তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। মক্কার লোকেরা ইহুদি বা খৃষ্টান ছিল না। তারা নিজেদেরকে ইবরাহীম (আঃ) এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (একনিষ্ঠ একত্ববাদী) বলত। মক্কা ছিল সমগ্র আরব ভূখণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সেকারণে খৃষ্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। এক সময় ইয়েমেনের নরপতি আবরাহা নিজ রাজধানীতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কাবা গৃহের আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ্জ করার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু জনগণ তাতে সাড়া দেয় নি। বরং কে একজন গিয়ে ঐ নকল কাবা গৃহে (?) পায়খানা করে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে প্রায় ৬০,০০০ সৈন্য ও হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করে কাবা গৃহকে ধংস করার জন্য। অবশেষে আল্লাহর গযবে তিনি নিজে তার সৈন্যসামন্ত সহ ধংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায় এবং এ ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। শেষনবী মুহাম্মদ (ছাঃ) এর ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। বস্তুতঃ এটা ছিল শেষ নবীর আগমনের আগাম শুভ সংকেত।

সমস্ত আরব ভূখণ্ডে মক্কার ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা শীতকালে ইয়েমেনে ও গ্রষ্মকালে শাম বা সিরিয়ায় ব্যবসার জন্য যাতায়াত করত। কিন্তু এই দীর্ঘ সফরে কখনো তাদের কাফেলা লুট হতো না। হারাম শরীফের মর্যাদার কারণে আপামর জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা এমন ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাদের সমীহ করত। এটাই যেখানে বাস্তবতা সেখানে তাদেরকে ‘জাহেলী আরব’ কেনো বলা হয়? এর কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ) -এর অনুসারী হবার দাবীদার হওয়া সত্বেও আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তি পূজা শুরু করেছিল। তারা শেষ নবীকে চিনতে পেরেও তাঁকে অস্বীকার করেছিল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল সবচেয়ে বড় জাহেলিয়াত ও সবচেয়ে বড় মূর্খতা। আর একারণেই তো “জ্ঞানের পিতা” আবুল হেকাম -কে “মূর্খতার পিতা” আবু জাহলকে দেওয়া হল।

এক্ষনে আমরা মক্কার শিরক প্রসারের ইতিবৃত্য সংক্ষেপে বর্ণনা করব :-

মক্কার ধর্মীয় অবস্থা (শিরকের প্রচলন):

মক্কার লোকেরা মূলতঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ) -এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কাবা গৃহকে যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে তাওয়াফ, সাই ও হজ্জ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজ নেতা ও ধনিক শ্রেনীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের মাধ্যমেই মূর্তি পূজার শিরকের সূচনা হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নুহ (আঃ) -এর সমাজে হয়েছিল।োর-ডাকাতেরাও তাদের সমীহ করত। এটাই যেখানে বাস্তবতা সেখানে তাদেরকে ‘জাহেলী আরব’ কেনো বলা হয়? এর কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ) -এর অনুসারী হবার দাবীদার হওয়া সত্বেও আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তি পূজা শুরু করেছিল।

(১) কুরায়েশ বংশের বনু খোযা’আহ গত্রের সর্দার আমর বিন লুহাই অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল এবং দরবেশ স্বভাবের লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং অন্ধভক্তি পোষন করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হত। অতএব শয়্তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামে গিয়ে দেখলেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের সাথে “হোবল” নামক মূর্তির পূজা করে। এর অসীলায় তারা বৃষ্টি প্রার্থনা করে। আমর ভাবল অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্ম ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন এই হোবল মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব। ফলে বহু মুল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরিদ করে নিয়ে গেল এবং মক্কার নেতাদের রাজি করিয়ে কা’বাগৃহে স্থাপন করল। কথিত আছে যে, একটা জীন আমরের অনুগত ছিল। (২) আর সেই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আঃ) -এর সময়কার অদ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াউক্ব, নাসর (নূহ ৭১/২৩) প্রতিমাগুলো জেদ্দার অমুক স্থানে মাটিতে গ্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিলো। অতঃপর হজ্জ এর মৌসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সোপর্দ করে দিলো। এসব মূর্তি ছাড়াও আরবের প্রাচিনতম মূর্তি ছিল লোহিত সাগরের নিকটবর্তী মুসাল্লাল নামক স্থানের “মানাত”, ত্বায়েফের “লাত” এবং নাখলা উপত্যকার ” ওয্যা” সবচাইতে প্রসিদ্ধ।

এভাবে আস্তে আস্তে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তির প্রচলন ঘটে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা’বা গৃহে ৩৬০টি মূর্তি দেখতে পান এবং সবগুলো বের করে এনে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেন ও কা’বাগৃহ পানি দিয়ে ধুয়ে সাফ করে ফেলেন।

বিদআতের প্রচলন:

মূর্তিপূজা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীমের উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম আছে। কেননা আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিল যে, এগুলি ইবরাহীমী দ্বীনের বিকৃতি নয়, বরং ‘বিদআতে হাসানাহ’। অর্থাৎ ভালো কিছুর সংযোজন মাত্র। এজন্য সে বেশ কিছু ধর্মীয় রীতি-পদ্ধতি আবিস্কার ও চালু করেছিল। যেমন-

(১) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয় বিনয় করে প্রার্থণা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদের আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩৯/৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশ করবে (ইউনুস ১০/১৮)।

(২) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, তাওয়াফ করত, তার সামনে প্রণত হত ও সিজদা করত।

(৩) তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত। সেখানে মূর্তির নামে কুরবানী করত (মায়েদাহ ৫/৬)।

(৪) তারা মূর্তিকে খুশি করার জন্য গবাদি পশু ও তাদের জন্য চরণক্ষেত্র মানত করত। যাদের কেউ ব্যবহার করতে পারত না (আনআম ৬/১৩৮-১৪০)।

(৫) তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভালো-মন্দ ফলাফল ও ভাগ্য নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকার তীর ব্যবহার করত। যাতে হ্যা, না, ভালো, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে অতঃপর তাতে ঝাকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুরিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত।

(৬) এতদ্ব্যতীত তারা জোতিষীদের কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গল-অমঙ্গলের কারণ মনে করত।

(৭) তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত।

দ্বীনে ইবরাহীমে উক্ত শিরক ও বিদআতসমূহ চালু করার পরেও তাদের অহংকার ছিল এই যে, (১) আমরা ইবরাহীম (আঃ) -এর দ্বীনে হানীফের খাটি অনুসারী। তারা কা’বা গৃহের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। অতএব তাদের সমকক্ষ আরব ভুখণ্ডে কেউ নেই। তাদের এই বড়ত্ব ও আভিজাত্যের অহংকার এতদূর পৌছে গিয়েছিল যে, তারা যেহেতু “হুমস” অর্থাৎ “সবচাইতে বড় বীর ও বড় ধার্মিক” অতএব তাদের পক্ষে “হারাম” -এর সীমানার বাইরে কোন হালাল এলাকায় যাওয়াটা মর্যাদাকর নয়। তারা যেহেতু “ক্বাতীন” বা ” আহলুল্লাহ” অর্থাৎ ” আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা” সেকারণে হজ্জের মৌসুমে “মুযদালিফায়” অবস্থান করত, যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে। হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ “তাওয়াফে আফাযাহ” করত না। যা ছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় রুকন। তারা মুযদালিফায় অবস্থান করত এবং সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসত। সেজন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন, ” অতঃপর তোমরা ঐ স্থান থেকে ফিরে এসো তাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে (অর্থাৎ আরাফাত থেকে)। (বাক্বারাহ ২/১৯৯)

(২) এতদ্ব্যতীত তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম তাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় কাপড় পরিধান করবে। সম্ভবতঃ এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থদুষ্ট বিদআত ছিল। যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তবে পুরুষরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পরে তাওয়াফ করবে। এতে তাদের দেহ এক প্রকার নগ্নই থাকত। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন, “হে বনু আদম! প্রতিবার মসজিদে উপস্থিত হবার সময় তোমাদের পোষাক পরিধান কর” (আরাফ ৭/৩১)। তাদের কাছ থেকে “হুমস” কাপড় কিনতে বাধ্য করার জন্য তারা এ বিধানও করেছিল যে, যদি বহিরাগত কেউ উত্তম পোষাকে এসে ত্বাওয়াফ করে, তাহলে ত্বাওয়াফ শেষে তাদের ঐ পোষাক খুলে রেখে যেতে হবে। যার দ্বারা কেউ উপকৃত হত না। (৩) তাদের বানানো আরেকটা বিদআতী রীতি ছিল এই যে, তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ীর সম্মুখ দিক দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু বাকী আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ির পিছন দিকের সরু পথ দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। সম্মুখ দরজা দিয়ে নয়। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে বৈষম্যগত শ্রেষ্ঠত্যের গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

” আর পিছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। বরং মঙ্গল রয়েছে আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। তোমরা ঘরে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে” (বাক্বারা ২/১৮৯)।

উপরোক্ত আলোচনায় তৎকালীন আরবের ও বিশেষ করে মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত শিরক ও বিদআতসমূহের একটা চিত্র পাওয়া গেল। যা তারা ইবরাহীম (আঃ) -এর একত্ববাদী দ্বীনে হানীফের মধ্যে ধর্মের নামে চালু করেছিল।

ইয়াছরিবের ইহুদী-নাছারাদের অবস্থা:

অপর পক্ষে যারা ইহুদী-নাছারা ছিল, যারা প্রধানতঃ ইয়াছরিবে (মদীনায়) বসবাস করত, যারা অত্যাচারী রাজা বখত নছর কতৃক কেনআন (ফিলিস্তিন) থেকে উৎখাত হওয়ার পর ইয়াছরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস হারিয়েছে, অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পথেয় হাছিল করবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তার আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তার দ্বীন কবুল করবে এবং তার নেতৃত্বে আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারণা ছিল আখেরী নবী অবশ্যই তাদের বংশ থেকে হবেন। কিন্তু তা না হওয়াতেই হল যত বিপত্তি। তাদের মধ্যে তাওরাত-ইঞ্জিলের কোন শিক্ষা অবশিষ্ট ছিল না। তাদের ধর্ম ও সমাজ নেতারা ভক্তদের কাছে “রব” এর আসন দখল করেছিল। ইহুদীরা ওযায়েরকে আল্লাহর বেটা বানিয়েছিল এবং নাছারারা মসীহ ঈসাকে একইভাবে দাবী করেছিল (তওবাহ ৯/৩০-৩১)। বরং তারা মারিয়াম, ঈসা ও আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তাদের পীর-দরবেশরা বাতিল পন্থায় ধর্মের নামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লুট করত এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতো (তওবাহ ৯/৩৪)। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম করত না (তওবাহ ৯/২৯)। এক কথায় তাওরাত-ইঞ্জিলের বাহক হবার দাবীদার হলেও তারা ছিল পূরা সেচ্ছারী দুনিয়াদার।

আরবের সামাজিক অবস্থা:

(ক) নারীদের অবস্থা: তৎকালীন আরবে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন বাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণির লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল। পুরুষ প্রধাণ সমাজ ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের ছিল মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও নায় ভিত্তিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। বহু ব্যপারে মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়া হত। তাদের যুক্তিসঙ্গত কথাবার্তার যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষন ও তাদের মান সম্মান অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত। তাদের মর্যাদা হানিকর কোন অবস্থার উদ্ভব ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তরবারি কোষমুক্ত হয়ে যেত। মহিলাদের মর্যাদা এতই উচুতে ছিল যে, বিবদমান গোত্রগুলিকে একত্রিত করে সন্ধিচুক্তি মম্পাদনেও তারা সক্ষম হত। পক্ষান্তরে তাদের উত্তেজিত বক্তব্যে ও কাব্য গাথায় যেকোন সময় দুই গোত্রে যুদ্ধ বেধে যেতে পারত। ওহুদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার সাথী মহিলাদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে এই কাজটিঈ করেছিল। তাদের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উচু মানের। উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতি ও কনের স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে নির্ধারিত মোহরানা দিয়ে বিয়ে করতে পারত। বিয়েতে ও সন্তানের আক্বীকাতে সমাজ নেতাদের দাওয়াত করে ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠান করা তাদের সামাজিক রেওয়াজ ছিল।

অপরপক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণির আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল। এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেণীর মত পারস্পরিক সম্মতি ও মোহরানা বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্তু বাকী তিনটাকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা উচিত। যা ভারতীয় হিন্দু সমাজে রাক্ষস বিবাহ, গান্ধর্ব্য বিবাহ ইত্যাদি নামে আধুনিক যুগেও চালু আছে বলে জানা যায়। আরবীয় সমাজে স্বাধীনা ও দাসী দুই ধরনের নারীদের অস্তিত্ব ছিল। দাসীদের অবস্থা ছিল মানবেতর। তারা বাজার-ঘাটে বিক্রয় হত। মনিবের মনোরঞ্জনই ছিল তাদের প্রধান কাজ। স্বাধীনাগণ সমাজে সম্মানিতা হিসাবে গণ্য হতেন।

(খ) গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা: আরবদের সমাজ ব্যবস্থা গোত্র প্রধান হওয়ার কারনে বংশীয় ও আত্বীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত। মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপর নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হত। নায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণিত হত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। আজকালকের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলী আরবের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়। বরং তাদের চাইতে নিম্নতর স্তরের দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। কেননা তখনকার যুগের ক্ষয়-ক্ষতির চাইতে আজকের যান্ত্রিক যুগের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়ভাবে বেশী। গোত্রসমূহের মধ্যে প্রায়ই যুধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারণে তারা অধিক সংখায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককেই সবাই সমীয় করত। যুদ্ধে পরাজিত হলে নারীদের বেইযযতি ও তাদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দারিদ্রতার কারণে অনেকে কন্যা সন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত। তাদের কোন গোত্রীয় আর্থিক রিজার্ভ ছিল না। যুদ্ধ শুরু হলে সবাই প্রয়োজনীয় ফান্ড গোত্র নেতার কাছে জমা করত ও তা দিয়ে যুদ্ধের খরচ মেটাত। তবে পূর্ব থেকেই ধর্মীয় রীতি চলে আসার কারণে তারা বছরে চারটি সম্মানিত মাসে (যুল-ক্বাদাহ, যুলহিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব) যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ রাখতো। এটা ছিল তাদের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রক্ষাকবচ। গোত্র নেতারা একত্রে বসে সামাজিক শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা, কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধ শুরু বা শেষ করা কিংবা সন্ধিচুক্তি করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করত। মক্কার “দারুন নাদওয়া” ছিল এজনয় বিখ্যাত [#১]। তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশীশক্তি-ই জয় লাভের মানদন্ড ছিল। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে “জোর যার মুল্লুক তার” নীতিতে পরিচালিত হত। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেই উন্নত নয়।

[ #১ “দারুন নাদওয়া” ছিল মসজিদে হারাম সংলগ্ন কুছাই বিন কেলাবের বাড়ী। ইসলামী যুগে এটি মসজিদুল হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ]

অর্থনৈতিক অবস্থা: ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। ত্বায়েফ, সিরিয়া, ইয়ামন প্রভৃতি উর্বর এলাকা ছাড়াও অন্যত্র পশু-পালন জনগণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। উট ছিল বিশেষ করে দুরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। গাধা ও খচ্চর মূলতঃ স্থানীয় পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হত। মক্কার ব্যবসায়ীগণ শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দুরপাল্লার ব্যবসায়ীক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সূদের প্রচলন ছিল। তারা চক্রবৃদ্ধি হারে পরস্পরকে সূদভিত্তিক ঋণ দিত। রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই ব্যবসায়িক কাফেলা লুট হত। সেজন্য সশস্ত্র যোদ্ধাদল নিয়ে ব্যবসায়ী কাফেলা রওয়ানা হত। তবে কাবা গৃহের খাদেম হওয়ার সুবাদে মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা বিশেষভাবে মর্যাদামন্ডিত ছিল এবং সর্বত্র নিরাপদ থাকত। বছরের আট মাসে লুটতরাজের ভয় থাকলেও বাকী চার মাস তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করত। এই সময় ওকাযের মেলা ছাড়াও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে আরো অনেকগুলি বড় বড় মেলা বসত। এইসব বানিজ্য মেলায় বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হত। তাদের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম ও ধাতব শিল্পের প্রচলন ছিল। ইয়ামন, হীরা ও সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল এইসব শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। তবে গৃহের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলাকে নিয়োজিত দেখা যেত। কোন কোন এলাকায় কৃষি কাজ হত। ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙ্গুরের চাষ হত। মক্কা-মদীনায় গমের আবাদ ছিল না। আমীর মুআবিয়ার খেলাফতকালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদীনায় গম রফতানী করা হয়। খেজুর বাগান ব্যপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।

তাদের কোন গোত্রীয় অর্থনৈতিক ফান্ড ছিল না। সেকারণে সমাজের লোকদের দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি দুরিকরণে ও স্বাস্থসেবার কোন সমন্বিত কর্মসূচি ও কর্মপরিকল্পনা ছিল না। পারস্পরিক দান ও বদান্যতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হত। নিখাদ পূজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে এক দল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক বিত্তহীন ও মানবেতর জীবন যাপন করত। সাধারন অবস্থা ছিল এই যে, আরবদের সহায়-সম্পদ তাদের জীবন্মান উন্নয়নে ব্যয়িত না হয়ে সিংহভাগই ব্যয়িত হত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে। ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র‍্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। আজকের বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর চেয়ে মোটেই উন্নত নয়। আরবীয় সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ, জুয়া ইত্যাদির ব্যপক প্রচলন ছিল। সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরুপে বিক্রয় হত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হত।

নৈতিক অবস্থা: উদার মরুচারী আরবদের মধ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ধারা পরিলক্ষিত হত। একদিকে যেমন তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি-হানাহানি লেগে থাকত। অন্যদিকে তেমনি দয়া, উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা ও অনাড়ম্বতা, দানশীলতা, আমানতদারী, মেহমানদারী, প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা ইত্যাদি সৎ গুণাবলীর সমাবেশ দেখা যেত। তাদের কাব্য প্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের কাছে আধুনিক যুগের আরবি কবি-সাহিত্যিকরা কিছুই নয়। তাদের স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই হুবহু মুখস্ত বলে দিত। বড় বড় ক্বাদীছা ও দীর্ঘ কবিতাগুলি তাদের মুখে মুখেই চালু ছিল। লেখাকে এজন্য তারা নিজেদের জন্য হীনকর মনে করত। দুর্বল স্মৃতির কারণে আজকের বিশ্ব লেখাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ লেখায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল কদাচিৎ হত। সম্ভবতঃ এইসব সদ গুণাবলীর কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতেই প্রেরণ করেন। যাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদীছ অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীতে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কুরআন ও হাদীছ লিখিত ভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল।

উপসংহার:

উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভুখন্ডের মরুচারী মানুষেরা বিভিন্ন মানবিক দুর্বলতার অধিকারী হলেও তাদের মধ্যে উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঈর্ষণীয়ভাবে পরিদৃষ্ট হত। আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার অবতরনস্থল হওয়ার কারণে এই ভুখণ্ড থেকেই মানব সভ্যতা ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য ভুখণ্ডে বিস্তার লাভ করেছে… এই ভুখণ্ডে আরাফাত -এর না’মান উপত্যকায় সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহ পাক সমস্ত মানবকূলের নিকট হতে তাঁর প্রভুত্বের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন (আরাফ ৭/১৭২-১৭৩)। একই সাথে তিনি সকল নবীর কাছ থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর উপরে ঈমান আনা ও ত্ঁাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতার অঙ্গীকার নেন (আলে ইমরান ৩/৮১)।

এই ভুখণ্ডে হাযার হাযার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। এই ভুখণ্ডেই আল্লাহর ঘর কা’বাগৃহ অবস্থিত। এই ভুখণ্ড বানিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জান্নাতের ভাষা আরবী এই ভুখণ্ডের কথিত ও প্রচলিত ভাষা ছিল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, প্রখর সৃতিশক্তি এবং সততা ও আমানতদারীর অনুপম গুণাবলীর প্রেক্ষাপটে আরব ভূমির কেন্দ্রবিন্দু মক্কাভূমির অভিজাত বংশ কা’বা গৃহের তত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাঃ) -এর নিকটেই আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত শ্রেষ্টতম নে’মত কুরআন ও সুন্নাহর আমানত সমর্পণ করেন। ফালিল্লা-হিল হামদ। এক্ষণে আমরা নবীজীবনের মূল আলোচনায় অগ্রসর হব।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ -১:

(১) বিশ্বনবী ও শেষনবী হবার কারণেই বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতে মুহাম্মাদ (ছাঃ) -কে প্রেরণ করা হয়।

(২) সারা বিশ্বে তাওহীদের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন বিশ্বের সেরা বাণিজ্য কেন্দ্র ও যোগাযোগ কেন্দ্র আরব ভূখণ্ডে শেষনবী প্রেরিত হন।

(৩) তাওরাত-ইঞ্জিল হিব্রু ভাষায় নাযিল হয়। কিন্তু কুরআন নাযিল হয়েছে জান্নাতী ভাষা আরবীতে। তাই আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক শুদ্ধভাষী আরব তথা কুরায়েশ বংশে শেষনবীর আগমন ঘটে।

(৪) আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র সে যুগে ছিল না। তাই প্রখর স্মৃতিধর আরবদের নিকটেই কুরআন ও সুন্নাহর অমূল্য নে’মত সংরক্ষণের আমানত সমর্পণ করা হয়।

(৫) আরবরা ছিল আজন্ম স্বাধীন ও বীরের জাতি। তাই তৎকালীন রোমক ও পারসিক পরাশক্তির মুকাবিলায় ইসলামী খেলাফতের বাস্তবায়নের জন্য শেষনবীর আগমনস্থল ও কর্মস্থল হিসাবে আরব ভূখণ্ডকে নির্বাচন করা হয়।

 

********************************

 

2. মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর জন্ম ও বংশ পরিচয়

 

 

রাসূলের মাক্কী জীবন:

নবী জীবনকে আমরা প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করে নেব, মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুঅত লাভ এবং মদীনায় তাঁর হিজরত, ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ। অতঃপর প্রথমেই তাঁর বংশ পরিচয় ও জন্ম বৃত্তান্ত।

বংশ পরিচয়:

ইবরাহীম (আঃ) -এর দুই পুত্র ছিলেন ইসলাঈল ও ইসহাক্ব। ইসমাঈলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাক্বের মা ছ্হিলেন বিবি সারা। দুই ছেলেই “নবী” হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাক্বের পুত্র ইয়াকূবও নবী ছিলেন এবং তার অপর নাম ছিল ” ইসরাঈল” অর্থ ” আল্লাহর দাস”। তাঁর বারোটি পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারুণ, দাউদ, সুলাইমান ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) ছিলেন এই বংশের সেরা নবী ও রাসূল। বলা চলে যে, আদম (আলাইহিস সালাম) হতে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আলাইহিস সালাম) সহ ৮-৯ জন নবী ছাড়া এক লক্ষ্য চব্বিশ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ) -এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক্ব (আঃ) এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইস্রাঈল। যাদের সর্বশেষ নবী ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর জোষ্ঠ পুত্র ইসমাইল (আঃ) এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনি-ই হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)। ফলে আদাম (আঃ) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবী ও তাদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা (হজ্জ ২২/৭৬)। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে মাঝে গিয়ে তাদের দেখাশুনা করতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন। অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক্ব ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেনআনে (ফিলিস্তিন) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আঃ) এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও ফিলিস্তিন দুই এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে।

কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহাম্মাদ (ছঃ) বাদে বাকি একুশ জন নবী ছিলেন বনু ইস্রাঈল এবং একমাত্র মুহাম্মাদ হলেন বনু ইসমাঈল। বলা চলে যে, এই বৈমাত্রের পার্থক্য উম্মতে মহাম্মাদীর বিরুদ্ধে ইহুদী-নাছারাদের বিদ্বেষের অন্যতম কারন ছিল। সেজন্য তারা চিনতে পেরেও শেষ নবীকে মানেনি (বাক্বারা ২/১৪৬; ৬/২০)।

এক্ষণে আমরা ইবরাহীম বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মানবজাতির গৌরব মুকুট, বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম -এর বংশ পরিচয় তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।

জন্ম ও মৃত্যু:

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ ই রবীউল আউয়াল সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় জন্মগ্রহন করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১২ ই রবীউল আউয়াল সোমবার সকালে ৯/১০ টার দিকে চন্দ্র বর্ষের হিসাবে ৬৩ বছর ৪ দিন বয়সে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌরবর্ষ হিসাবে জন্ম ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ৬ ই জুন সোমবার। বয়স ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা’বা আক্রমণের ৫০ অথবা ৫৫ দিন পরে। এটা ছিল ইবরাহীম (আঃ) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরের এবং নূহের তূফানের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা। রাসূল (ছাঃ) দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘন্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুঅত কাল ছিল ৮১৫৬ দিন। এ হিসাব হল সুলায়মান মানছুরপুরীর। সঠিক হিসাব আল্লাহ জানেন।

বংশ: তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা, দাদার নাম আব্দুল মুত্তালিব, দাদীর নাম ফাতেমা। নানার নাম ওয়াহাব, নানীর নাম বাররাহ। নানার বংশসূত্র রাসূলের উর্ধ্বতন দাদা কিলাব -এর সাথে এবং নানীর বংশসূত্র কুছাই -এর সাথে যুক্ত হয়েছে। নানা অয়াহাব বনু যোহরা গোত্রের সরদার ছিলেন। দাদার হাশেমী গোত্র ও নানার যোহরা গোত্র কুরায়েশ বংশের দুই বৃহ্ৎ ও সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল।

বংশধারা (শাজারাহ):

তাঁর বংশধারাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১ম ভাগে মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’তে উর্ধ্বতন পুরুষ আদনান পর্যন্ত ২২টি স্তর। যে ব্যপারে কারু কোন মতভেদ নেই। এর উপরে ২য় ভাগে আদনান থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ৪১টি স্তর এবং তাঁর উপরে তৃতীয় ভাগে ইবরাহীম (আঃ) হ’তে আদম (আঃ) পর্যন্ত ১৯টি স্তর। যেখানে নাম ও স্তরের ব্যপারে বিদ্বানগণের মতভেদ রয়েছে। আমরা নিম্নে আদনান পর্যন্ত বংশধারা উল্লেখ করলাম-

(১) মুহাম্মাদ বিন (২) আব্দুল্লাহ বিন (৩) আব্দুল মুত্তালিব বিন (৪) হাশেম বিন (৫) আবদে মানাফ বিন (৬) কুছাই বিন (৭) কিলাব বিন (৮) মুররাহ বিন (৯) কা’ব বিন (১০) লুওয়াই বিন (১১) গালিব বিন (১২) ফিহর (লকব কুরায়েশ) বিন (১৩) মালেক বিন (১৪) নাযার বিন (১৫) কানানাহ বিন (১৬) খুযায়মা বিন (১৭) মুদরেকাহ বিন (১৮) ইলিয়াস বিন (১৯) মুযার বিন (২০) নাযার বিন (২১) মা’দ বিন (২২) আদনান। এর মধ্যে পরদাদা হাশেম -এর নামে হাশেমী গোত্র এবং দ্বাদশতম পুরুষ ফিহর যার উপাধি ছিল কুরায়েশ, তাঁর নামানুসারে কুরায়েশ বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। কুরায়েশ অর্থ সাগরের তিমি মাছ। ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান মক্কা আক্রমণ করে কা’বা উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে ছেয়েছিল। ফিহর তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দি করে রাখেন। অতঃপর তাকে মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যায়। এই ঘটনার পর থেকে ফিহর ” আরবের কুরায়েশ” বলে খ্যাতি লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় বংশ সম্পর্কে বলেন,

” আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কানানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কানানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপপ্র কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন” [২]।

শুধু তাই নয়, তিনি বলতেন, আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো’আ ও ঈসার সুসংবাদ (এর ফসল)” [৩]। কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো’আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়-

“হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের মধ্যে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করুন, যিনি তাদের নিকটে আপনার আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন” (বাক্বারাহ ২/১২৯)।

পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো’আ দুই হাযারের অধিক বছর পরে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর আগমনের মাধ্যমে বাস্তবে রুপ লাভ করে।

একইভাবে ঈসা (আঃ) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে শেষনবী আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন, যেমন আল্লাহ বলেন,

“স্মরণ কর, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা বলেছিলেন, হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যনকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম আহমাদ…” (ছফ ৬১/৬)।

পিতা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে পিতার হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ও সেখানে নাবেগা জাদীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) -এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়।

খাৎনা ও নামকরণ:

প্রচলিত প্রথা মোতাবেক সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়। পিতৃহীন নবজাতককে কলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব কা’বা গৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো’আ করেন। আক্বীকার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, “মুহাম্মাদ”। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় “প্রশংসিত” হৌক। ওদিকে সপ্নের মাধ্যমে ফেরেস্তার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ” আহমাদ”। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’। উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহাম্মাদ্ִ নাম এসেছে চার জায়্গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০, মুহাম্মাদ ৪৭/২, এবং ফাৎহ ৪৮/২৯। তাছাড়া ‘মুহাম্মাদ্ִ নামেই একটা সূরা নাযিক হয়েছে – সূরা মুহাম্মাদ (৪৮ নং)। অনুরুপভাবে ‘ আহমাদ্ִ নাম এসেছে এক জায়্গায় (ছফ ৬১/৬)।

কথিত আছে যে, (১) রাসূল খাৎনা করা অবস্থায় জামা-পাজামা পরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, যাতে কেউ তাঁর লজ্জাস্থান দেখতে না পায়। (২) এছাড়াও কথিত আছে যে, জান্নাত থেকে আসিয়া ও মারিয়াম নেমে এসে ধাত্রীর কাজ করেন। (৩) আরও কথিত আছে যে, রাসূলের জন্মের সংবাদ শুনে চাচা আবু লাহাব আনন্দে আত্মহারা হয়ে মক্কার ওলি-গলিতে এই সুসংবাদ শুনানোর জন্য দৌড়ে যান এবং তাকে প্রথম সংবাদদানকারিণী দাসী ছুওয়াইবাকে খুশির নিদর্শন স্বরুপ মুক্ত করে দেন। মীলাদের মজলিসে আরও বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল জন্মের সংবাদ দেবার সময় আবু লাহাবের শাহাদাত আংুলী উচু ছিল বিধায় খুশিতে সেটি জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ থাকবে। বলা বাহুল্য, এই সবই ভিত্তিহীন কল্পকথা মাত্র। (৪) বিশ্বসেরা জীবনীগ্রন্থ হিসাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত আর-রাহীকুল মাখতুমেও কিছু অশুদ্ধ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, যা উক্ত গ্রন্থের উচ্চ মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে। যেমন- (ক) রাসূল জন্মের সময় তাঁর মা বলেছেন যে, আমার গুপ্তাঙ্গ দিয়ে ‘নূর্ִ অর্থাৎ জ্যোতি বিকশিত হয়েছিল। যা সিরিয়ার প্রাসাদসমূহকে আলোকিত করেছিল। (খ) পারস্যের কিসরা রাজপ্রাসাদের ১৪টি চূড়া ভেঙ্গে পড়েছিল (গ) অগ্নি উপাসক মজূসীদের পূজার আগুন নিভে গিয়েছিল (ঘ) বহীরাহর পার্শ্ববর্তী গীর্জাসমূহ ধসে পড়েছিল ইত্যাদি (পৃঃ ৫৪)। উল্লেখ্য যে, অনুবাদক তাঁর অগণিত ভুল অনুবাদের মধ্যে ঐ সাথে এটাও যোগ করেছেন যে, (ঙ) ঐ সময় কা’বা গৃহের ৩৬০ টি মূর্তি ভুলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে’ (পৃঃ ৭৬), [প্রকাশক- তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ধাকা, সেপ্টেমবর ২০০৯)।

রাসূলের নাম সমূহ:

রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ” আমার কয়েকটি নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি “মাহী” (বিদূরিতকারী) আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের্ִ’ (জমাকারী) কেননা সমস্ত লোক কিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফায়াতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘ আক্বেব্ִ’ (সর্বশেষ আগমণকারী) আমার পরে আর কোন নবী নেই [৪]। সুলায়মান মান্ছূর্পুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম। সেজন্য তিনি সেগুলোর ব্যখ্যা করেছেন। এই গুণবাচক নাম মান্ছূর্পুরী গণনা করেছেন ৫৪টি। তিনি ৯২টি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

(ক) রাসূলের মৃত্যুর পরে কন্যা ফাতেমার শোকগাথাতেও ‘ আহমাদ্ִ’ নাম এসেছে। যেমন-

– আমার উপরে এমন বিপদ আপতিত হয়েছে, যদি তা দিনের উপর পড়ত, তবে তা রাত হয়ে যেত।

– যে কেউ আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে, তার উপরে ওয়াজিব হবে যে সে সারাটি জীবনে আর কোন সুগন্ধি শুঁকবে না।

এমনি ভাবে কট্টর্পন্থী খারেজীরা যখন আলী (রাঃ) -কে নতুনভাবে তাদের সামনে ঈমান আনতে ও ইসলামে দাখিল হ’তে বলে, তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ” আমার উপরে হে কল্যাণের সাক্ষী, সাক্ষী থাক, নিশ্চয়ই আমি নবী আহমাদের দ্বীনের উপরে রয়েছি, আল্লাহর ব্যপারে যে সন্দেহ পোষণ করে সে জেনে রাখুক যে, আমি হেদায়াত প্রাপ্ত”। উল্লেখ্য যে, চরমপন্থী খারেজীরা আলী (রাঃ) -কে ‘কাফের্ִ ফৎোয়া দিয়ে তাঁকে ফজরের জামা’আতে মসজিদে যাওয়ার সময় মর্মান্তিকভাবে হত্যা করেছিল এবং হত্যাকারী আব্দুর রহমান নির্বিকারভাবে সেখানে দাড়িয়ে থেকে লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, ” আমি খুবই আনন্দিত এজন্য যে, আমি আজ আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টিকে হত্যা করেছি”।

(খ) ওদিকে ‘মুহাম্মাদ্ִ’ নামের প্রশংসায় কবি হাসসান বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) গেয়েছেন-

“তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করেছেন। তাই আরশের মালিক হ’লেন মাহমূদ এবং ইনি হএন মুহাম্মাদ”।

উল্লেখ্য যে, ক্বিয়ামাতের দিন রাসূলের শাফা’আতের স্থানের নাম হবে ‘মাক্বামে মাহমূদ্ִ।

(ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব রচিত “পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ২৫ জন নবীর কাহিনী” থেকে সংকলিত।)

[২] ছহীহ মুসলিন, ওয়াছেলাহ ইবনুল আসক্বা হতে; মিশকাত হা/৫৭৪০ ‘ফাযায়েল্ִ অধ্যায়।

[৩] আহমাদ, ইবনু হিব্বান, আবু উমামাহ হ’তে; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/১৫৪৫।

[৪] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত।

 

********************************

 

3. শিশু মুহাম্মাদের বেড়ে ওঠা

 

 

ধাত্রীগৃহে মুহাম্মাদ:

সে সময় শহরবাসী আরবদের মাঝে এই প্রথা চালু ছিল যে, শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত থাকে এবং তাদের স্বাস্থ সবল ও সুঠাম হয়। সর্বোপরি তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। সে হিসাবে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ধাত্রী হিসাবে বনু সা’দ গোত্রের হালীমা সা’দিয়াহকে নির্বাচন করেন এবং তার হাতেই প্রাণাধিক পৌত্রকে সমর্পণ করেন। হালীমা গৃহে দু’বছর দুগ্ধপানকালীন সময়ে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। তাদের ছাগপালে এবং অন্যান্য সকল বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বরকত নেমে আসে। নিয়মানুযায়ী দু’বছর পরে বাচ্চাকে ফেরত দেওয়ার তাঁকে তার মা আমেনার কাছে আনা হয়। কিন্তু হালীমা তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তিনি মা আমেনাকে বারবার অনুরোধ করেন আরো কিছুদিন বাচ্চাকে তার কাছে রাখার জন্য। ঐ সময় মক্কায় মহামারী দেখা দিয়েছিল। ফলে মা আমেনা রাযী হয়ে যান এবং বাচ্চাকে পুনরায় হালীমার কাছে অর্পণ করেন।

বক্ষ বিদারণ:

দ্বিতীয় দফায় হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) অন্যান্য সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে অনতিদূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলিজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দিলেন এবং বললেন, ‘শয়তানের যে অংশ তোমার মধ্যে ছিল, সেটা এই’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পুরা ব্যপারটা খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালিমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। তিনি ছুটে এসে দেখেন যে, মুহাম্মাদ মলিন মুখে দাড়িয়ে আছে [৫]। হালিমা তাকে বুকে তুলে বাড়ীতে এনে সেবাযত্ন করতে থাকেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছয় বছর।

আমেনার ইয়াছরিব গমন ও মৃত্যুবরণ:

প্রাণাধিক সন্তানকে কাছে পেয়ে আমেনা তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর কবর যেয়ারত করার মনস্থ করেন। শ্বশুর আব্দুল মুত্তালিব সব ব্যবস্থা করে দেন। সে মতে পুত্র মুহাম্মাদ ও পরিচারিকা উম্মে আয়মনকে নিয়ে তিনি মক্কা হ’তে ৫০০ কিঃ মিঃ দূরে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর যথাসময়ে মদীনায় পৌছে নাবেগা আল-জাদী পরিবারের গোরস্থানে স্বামীর কবর যেয়ারত করেন। অতঃপর সেখানে এক মাস বিশ্রাম নেন। এরপর পুনরায় মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু কিছু দূর এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও আবওয়া নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে আসেন। এভাবে জন্ম থেকে পিতৃহারা ইয়াতীম মুহাম্মাদ মাত্র ৬ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে পুনরায় ইয়াতীম হলেন।

দাদার স্নেহনীড়ে মুহাম্মাদ:

ইয়াতীম মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্নেহনীড়ে। আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজেও ছিলেন জন্ম থেকে ইয়াতীম। পিতা কুরায়েশ নেতা হাশেম ফিলিস্তিনের গাযায় মৃত্যুবরণ করলে তিনি ১০ বছর পর্যন্ত তিনি ইয়াছরিবে তার মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। ব্যপারটা ছিল এই যে, ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায় যাওয়ার পথে হাশেম ইয়াছরিবে জনৈকা সালমা বিনতে আমরের সাথে বিবাহিত হন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি সিরিয়া গমন করেন ও ফিলিস্তিনের গাযায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই বিয়ে ও সন্তান জন্মের খবর মক্কার অভিভাবকরা জানতেন না। ১০ বছর পর তার জন্মের খবর জানতে পেরে চাচা কুরায়েশ নেতা মুত্ত্বালিব বিন আবদে মানাফ তাকে মক্কায় নিয়ে আসেন। লোকেরা তাকে মুত্ত্বালিবের কৃতদাশ মনে করে তাকে ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব্ִ বলেছিল। সেই থেকেই তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। যদিও তার আসল নাম ছিল ‘শায়বাহ্ִ অর্থ ‘সাদা চুল্ִ। কারন জন্ম থেকেই তার মাথার চুল ছিল সাদা। সেই শিশুকালের ইয়াতীম আব্দুল মুত্ত্বালিব আজ বৃদ্ধ বয়সে নিজ ইয়াতীম পৌত্রের অভিভাবক হন। কিন্তু এ স্নেহনীড় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।

মাত্র দু’বছর পরে শিশু বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। ফলে তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী আপন চাচা আবু ত্বালিব তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি ভাতিজার অভিভাবক হিসেবে জীবনপাত করেন।

শিশু মুহাম্মাদের কিছু বরকতমণ্ডিত নিদর্শন:

(১) হালীমা সা’দিয়াহ বলেন, ক্ষুধা-তৃষ্ঞায় আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাহন মাদী গাধাটির অবস্থাও ছিল তদ্রুপ। কেননা এই সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষের বছর চলছিল। ফলে বেশী অর্থ পাবে না বলে ইয়াতীম মুহাম্মাদকে কেউ নিতে চাচ্ছিল না। অবশেষে আমি তাকে নিতে সম্মত হলাম। অতঃপর যখন তাকে বুকে রাখলাম, তখন সে এবং আমার গর্ভজাত সন্তান দু’জনে পেটভরে আমার বুকের দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। ওদিকে উটনীর পালান দুধে ভরে উঠল। যার দুধ আমরা সবাই তৃপ্তির সাথে পান করলাম। তখন আমার স্বামী হারেছ বললেন, “হালীমা! আল্লাহর শপথ! তুমি এক মহাভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ”। তারপর বাড়ীতে ফিরে আসার পর দেখা গেল যে, আমাদের সেই দুর্বল মাদী গাধাটি এত তেযী হয়ে গেছে যে, কাফেলার সবাইকে পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। যা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল।

(২) বাড়ীতে ফিরে এসে দেখা গেল আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যেত অন্যান্য রাখালরাও সেখানে পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তাদের পশুপাল ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরত। অথচ আমাদের পশুপাল পরিতৃপ্ত অবস্থায় এবং পালানে দুধভর্তি অবস্থায় বাড়ী ফিরত। এভাবে প্রতিটি ব্যপারেই আমরা বরকত লক্ষ্য করলাম এবং আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এল।

(৩) কাবা চত্বরের যে নির্দিষ্ট স্থানটিতে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব বসতেন, সেখানে তার জন্য নিএদিষ্ট আসনে কেউ বসতো না। কিন্তু শিশু মুহাম্মাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এসে সরাসরি দাদার আসনেই বসে পরতেন। তার চাচারা তাকে সেখান থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাকে নিজের কাছেই বসাতেন ও গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলতেন, ” আমারে বেটাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম! এর মধ্যে বিশেষ কিছু শুভ লক্ষণ আছে”।

(৪) দাদার মৃত্যুর পর শিশু মুহাম্মাদ চাচা আবু ত্বালিবের নিকটে লালিত-পালিত হন। আবু ত্বালিব তখন কুরায়েশগণের সরদার। বৃষ্টির অভাবে মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। লোকেরা এসে আবু ত্বালিবকে বলল, চলুন সবাই আল্লাহর নিকটে পানি প্রার্থনা করি। আবু ত্বালিব শিশু মুহাম্মাদকেও সাথে নিলেন এবং কাবা গৃহের দেয়াল ঘেষে নিজের কাছে দাড় করিয়ে পানি প্রার্থনা করলেন। এমন সময় আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি নেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ভরে উঠলো। তৃষিত মক্কায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে মুগ্ধ-বিষ্মিত আবু ত্বালিব ভাতিজার প্রশংসায় বলেন, “শুভ্র দর্শন (মুহাম্মাদ) যার চেহারার অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। সে যে ইয়াতীমদের আশ্রয়্স্থল ও বিধবাদের রক্ষক”।

কিশোর মুহাম্মাদ:

১২ বছর বয়সে চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষ্যে সর্বপ্রথম সিরিয়া গমন করেন। সেখানে জারজীস অরফে বুহায়রা নামক জনৈক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাহেব অর্থাৎ খৃষ্টান পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি মক্কার কাফেলাকে গভীর অতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন এবং কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে কাফেলা নেতা আবু ত্বালেবকে বলেন, “েই বালক হ’ল বিশ্ব জাহানের নেতা, একে আল্লাহ বিশ্ব চরাচরের রহমত হিসেবে প্রেরণ করবেন”। আবু ত্বালেব বললেন, কিভাবে আপনি এই কথা বুঝলেন? তিনি বললেন, গিরিপথের অপর প্রান্ত থেকে যখন আপনাদের কাফেলা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল, তখন আমি খেয়াল করলাম যে, সেখানে এমন কোন প্রস্তরখণ্ড বা বৃক্ষ ছিল না যে এই বালককে সিজদা করেনি। আর নবী ব্যতীত এরা কাউকে সিজদা করে না। এতদ্ব্যতীত ‘মোহরে নবুঅত্ִ দেখে আমি তাকে চিনতে পেরেছি, যা তার স্কন্ধদেশের নীচে ছোট্ট ফলের আকৃতিতে উচু হয়ে আছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থে আখেরী নবীর এসব আলামত সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি। অতএব হে আবু ত্বালেব! আপনি সত্বর একে মক্কায় পাঠিয়ে দিন। নইলে ইহুদীরা জানতে পারলে ওকে মেরে ফেলতে পারে। অতঃপর চাচা তাকে কিছু গোলামের সাথে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন।

তরুণ মুহাম্মাদ:

তিনি যখন পনের কিংবা বিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন ফিজার যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে একপক্ষে ছিল কুরায়েশ ও তাদের মিত্র বনু কিনানাহ এবং অপর পক্ষে ছিল ক্বায়েস আয়লান। যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের জয় হয়। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলে সম্মানিত মাস (যে মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ) এবং কাবার পবিত্রতা নষ্ট হয় বলে একে ‘হারবুল ফিজার্ִ বা দুষ্টদের যুদ্ধ বলা হয়। তরুণ মুহাম্মাদ এই যুদ্ধে চাচাদের তীর যোগান দেবার কাজে সহায়তা করেন। উল্লেখ্য যে, ফিজার যুদ্ধ মোট চারবার হয়। প্রথমটি ছিল কিনানাহ ও হাওয়াযেন গোত্রের মধ্যে। দ্বিতীয়টি ছিল কুরায়েশ ও হাওয়াযেন এর মধ্যে। তৃতীয়টি ছিল কিনানাহ ও হাওয়াযেন এর মধ্যে এবং সর্বশেষ ও চতুর্থটি ছিল কুরায়েশ ও কিনানাহ মিলিতভাবে ক্বায়েস আয়লানের বিরুদ্ধে।

‘হিলফুল ফুযূল্ִ’ বা ‘কল্যাণকামীদের সংঘ’:

ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখে দয়াশীল মুহাম্মাদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। যাতে এইরুপ ধ্বংসলীলা আর না ঘটে, সেজন্য তিনি গভির চিন্তায় মগ্ন হলেন। এই সময় হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটে যায়। যুবায়েদ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ব্যবস্যা উপলক্ষ্যে মক্কায় এসে অন্যতম কুরায়েশ নেতা আছ বিন ওয়ায়েল এর নিকটে মালামাল বিক্রয় করেন। কিন্তু তিনি মূল্য পরিশোধ না করে মাল আটকে রাখেন। তখন লোকটি অন্য সব নেতাদের কাছে সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে উঠে সবাইকে উদ্দেশ্য করে হৃদয় বিদারক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। রাসূলের চাচা যুবায়ের বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এই আওয়ায শুনে ছুটে যান এবং ঘটনা অবহিত হয়ে তিনি অন্যান্য গোত্র প্রধানদের নিকট গমন করেন। এই সময় তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ বিন জাদআন তায়মীর গৃহে বনু হাশেম, বনু মুত্ত্বালিব, বনু আসাদ, বনু যোহরা, বনু তামীম প্রভৃতি গোত্র প্রধানদের দেকে বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে রাসূলের দাদা ও নানার গোত্র সহ পাচটি গোত্র যোগদান করে। বৈঠকে তরুণ মুহাম্মাদ কতগুলি কল্যাণমূলক প্রস্তাব পেশ করেন, যা নেতৃবৃন্দের প্রশংসা অর্জন করে এবং চাচা যোবায়েরের দৃঢ় সমর্থনে বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মুলতঃ ভাতিজা মুহাম্মাদ ছিলেন উক্ত কল্যাণচিন্তার উদ্ভাবক এবং পিতৃব্য যোবায়ের ছিলেন তার প্রথম ও প্রধান সমর্থক। চুক্তিগুলো ছিল-

(১) আমরা সমাজ থেকে অশান্তি দূর করব (২) মুসাফিরদের হেফাযত করব (৩) দুর্বল ও গরিবদের সাহায্য করব (৪) যালেমদের প্রতিরোধ করব। হরবুল ফিজারের পরে যুলক্বাদাহর নিষিদ্ধ মাসে আল্লাহর নামে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি সম্পাদনের পরপরই তারা আছ বিন ওয়ায়েল এর কাছে যান এবং তার নিকট থেকে উক্ত মযলুম যুবায়দী ব্যবসায়ীর প্রাপ্য হক বুঝে দেন। এরপর থেকে সারা মক্কায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। অথচ ইতিপূর্বে নিয়ম ছিল গোত্রীয় বা দলীয় কোন ব্যক্তি শত অন্যায় করলেও তাকে পুরা গোত্র মিলে সমর্থন ও সহযোগীতা করতেই হত। যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে দলীয় ব্যক্তির সমর্থনে নেতা-কর্মীরা করে থাকে।

আল-আমীন মুহাম্মাদ:

হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবর্দস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলূমের হক আদায়ের ঘটনায় চারদিকে তরুণ মুহাম্মাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সবার মুখে মুখে তিনি ‘আল-আমীন্ִ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার বলে অভিহিত হতে থাকেন। অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল-আমীন্ִ বলে ডাকত।

 

********************************

 

4. রাসূল (ছাঃ) -এর ব্যবসা, বিবাহ ও সন্তান-সন্ততি:

 

 

যুবক ও ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ:

১২ বছর বয়সে পিতৃব্য আবু ত্বালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসা উপলক্ষ্যে শাম বা সিরিয়া সফর করেছিলেন। কিন্তু বোহায়রা রাহেবের কথা শুনে চাচা তাকে সাথে সাথেই মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন। এখন তিনি ২৫ বছরের পরিণত যুবক। কুরায়েশ বংশে অনেকে ছিলেন, যারা নির্দিষ্ট লভ্যাংশের বিনিময়ে ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু নিজেরা সরাসরি ব্যবসায়িক সফরে যেতেন না। এজন্য তারা সর্বদা বিশ্বস্ত ও আমানতদার লোক তালাশ করতেন। খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন এমনি একজন বিদুষী ব্যবসায়ী মহিলা। মুহাম্মাদের সততা ও আমানতদারীর কথা শুনে তিনি তার নিকটে অন্যদের ছেয়ে অধিক লভ্যাংশ দেওয়ার অংগিকারে ব্যবসায়ের প্রস্তাব পাঠান। চাচার সাথে পরামর্শক্রমে তিনি এতে রাযী হয়ে যান। অতঃপর খাদীজার গোলাম মায়সারাকে সাথে নিয়ে প্রথম ব্যবসায়ীক সফরে তিনি সিরিয়া গমন করেন। ব্যবসা শেষে মক্কায় ফিরে আসার পরে হিসাব-নিকাশ করে মূল পুঁজি সহ এতবেশী লাভ হস্তগত হয় যে, খাদীজা ইতিপূর্বে কারু কাছ থেকে এত লাভ পাননি।

বিবাহ:

ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশি হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে পর পর দু’জন স্বামী মৃত্যুবরণ করায় মক্কার সেরা নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করেননি। এবার তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ -এর নিকটে। তখন উভয় পক্ষের মুরব্বীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দু’মাসের মাথায় সমাজ নেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মুহাম্মাদ স্বীয় বিবাহের মোহরানা স্বরুপ ২০টি উট প্রদান করেন। এই সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ট ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসেবে তিনি ‘তাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী।

সন্তান-সন্ততি:

পঁচিশ বছর তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়। ইবরাহীম ব্যতীত রাসূলের সকল সন্তান ছিলেন খাদীজার গর্ভজাত। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (ছাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর সাথে বিয়ের সময় খাদীজা পূর্ব স্বামীদ্বয়ের কয়েকজন মৃত ও জীবিত সন্তানের মা ছিলেন। তার গর্ভজাত ও পূর্ব স্বামীর তিন ছেলে হালাহ, তাহের ও হিন্দ সকলে ছাহাবী ছিলেন। খাদীজার গর্ভে রাসূলের প্রথম সন্তান ছিল ক্বাসেম। তার নামেই রাসূলের উপনাম ছিল আবুল ক্বাসেম। অতঃপর কন্যা যয়নব, রুক্বাইয়া, উম্মে কুলছূম, ফাতেমা সবশেষে পুত্র আব্দুল্লাহ, যার লকব ছিল ত্বাইয়িব ও ত্বাহের। রাসূলের সকল পুত্র সন্তান শৈশবেই মারা যান। কন্যাগণ সবাই বিবাহিত হন ও হিজরত করেন। কিন্তু ফাতেমা ব্যতীত সবাই রাসূলের জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলের অন্য পুত্র ‘ইবরাহীম্ִ ছিলেন অন্য স্ত্রী মারিয়া ক্বিবতীয়ার গর্ভজাত। যিনি মদিনায় সর্বশেষ সন্তান হিসাবে জন্ম গ্রহণ করেন এবং দুধ ছাড়ার আগেই ১০ম হিজরীর ২৯ শাওয়াল সোমবার মাত্র ১৮ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন।

 

********************************

 

5. রাসূল (ছাঃ) -এর মধ্যস্থতায় কা’বা পুনর্নির্মাণ

 

 

কা’বা গৃহ পুনঃনির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা:

আল-আমীন মুহাম্মাদ -এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা’বাগৃহ ভেঙ্গে পুনঃনির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া ন্যূনাধিক আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিসমৃদ্ধ এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনঃনির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশ নিতে চায়।

ইবরাহীমী যুগ থেকেই কা’বা গৃহ ৯ হাত উচু চার দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না। কা’বা অর্থই হল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির তীব্র স্রোতের আঘাতে কা’বার দেওয়াল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কা’বা পুনঃনির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা’বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়। অতঃপর কা’বা গৃহ পুনঃনির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, কারু কোনরুপ হারাম মাল এই নির্মাণ কাজে লাগানো যাবে না। কোন কোন গোত্র কোন পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে? অবশেষে ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ মাখ্যূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তার্পর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ) -এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে “বাকুম” নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু গোল বাধে দক্ষিন-পূর্ব কোণে “হাজারে আসওয়াদ” স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তারক্তিতে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। এই সময় প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযূমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম হারাম শরীফে প্রবেশ করবেন, তিনি এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল। আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, সকালে সবার আগে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সবার প্রিয় আল-আমীন। তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো- “ে যে মুহাম্মাদ, এ যে আল-আমীন, আমরা সবাই তার উপরে সন্তুষ্ট”। তিনি ঘটনা শুনে সহজেই মিমাংসা করে দিলেন। তিনি একটা চাদর চাইলেন। অতঃপর সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে “হাজারে আসওয়াদ”-টি তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরুন অতঃপর উঠিয়ে নিয়ে চলুন। তাই করা হল। কা’বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেকে দিলেন। সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারিফ করতে করতে চলে গেল। আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হত কি-না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তার প্রতি ব্যপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো। নেতাদের মধ্যে তার প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হল।

কিন্তু নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু আদী বিন কা’ব নিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ঐ অংশের প্রায় ৬ হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। যা হাত্বীম বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। সেকারণ হাত্বীমের বাহির দিয়েই ত্বাওয়াফ করতে হয়, ভিতর দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের পরে ঐ অংশটুকু কা’বার মধ্যে শামিল করে পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরায়েশরা সেটা মেনে নেবে না ভেবে পুনর্নির্মাণ করেননি। পরে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) -এর খেলাফত কালে ৬৪ হিজরীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছঃ) -এর উক্ত ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মক্কা অবরোধ কালে ৭৩ হিজরীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) শহীদ হলে কা’বা পুনর্নির্মান করা হয় এবং পূর্বের ন্যায় হাত্বীমকে বাইরে রাখা হয়। যা আজও আছে। অথচ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) যেটা করেছিলেন, সেটাই সঠিক ছিল। কিন্তু অন্ধ রেওয়াজ পূজার জয় হল।

কা’বার আকৃতি:

কুরায়েশগণ কতৃক নির্মিত কা’বা (যার রুপ বর্তমানে রয়েছে), দেওয়ালের উচ্চতা ১৫ মিটার, ৬টি স্তম্ভের উপর নির্মিত হয় এবং দরজার নিচের চৌকাঠ ২ মিটার উচ্চতায়, যাতে তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে না পারে। অথচ রাসূলের ইচ্ছা ছিল, হাত্বীমকে অন্তরভুক্ত করে মূল ভিতের উপর কা’বা গৃহ নির্মাণ করবেন। যা মাটি সমান হবে এবং যার পূর্ব দরজা দিয়ে মুসল্লী প্রবেশ করবে ও ছালাত শেষে পশ্চিম দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উচুতে দরজা নির্মাণ করে যাতে তাদের ইচ্ছার বাইরে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। খালা আয়েশা (রাঃ) -এর নিকট এ হাদীছ শোনার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নু যুবায়ের (রাঃ) স্বীয় খেলাফত কালে ৬৪ হিজরী সনে কা’বা গৃহ ভেঙ্গে রাসূলের ইচ্ছানুযায়ী পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু তিনি শহীদ হওয়ার পর ৭৩ হিজরী সনে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তা পুররায় ভেঙ্গে আগের মতো নির্মাণ করেন। যা আজো রয়েছে। পরবর্তীতে আব্বাসীয় খলিফা মাহদী ও হারুণ এটি পুনর্নির্মাণ করে রাসূলের ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক (রহঃ) তাদেরকে বলেন, আপনারা কা’বা গৃহকে বাদশাহদের খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত করবেন না [১]। ফলে আজও কা’বা গৃহ একই অবস্থায় রয়েছে। ইবরাহীমী ভিত্তিতে আজও ফিরে আসেনি। শেষনবীর আকাংখাও পূর্ণ হয়নি।

[১] ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১২৭-২৮; ঐ, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/২৫৩।

******************************

 

Leave a comment